চাঁদের আলোয় জোঁছনা ভাঙ্গে (পর্ব-০৩)


চাঁদের আলোয় জোঁছনা ভাঙ্গে (পর্ব-০৩)

আধাঁর ঘনিয়ে সন্ধ্যেটা, কেমন ঝাঁকিয়ে বসেছে। চারপাশে কেবলই বাড়ি ফেরার তাগিদ। প্রকৃতির নিগুম নিস্তব্ধতা কাটিয়ে দু'একটি পাখির কিচিরমিচির শব্দ কানে আসছে। তার উপর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে পরিবেশটা বড় রোমাঞ্চনীয় হয়ে অনন্যার চোখে ধরা দিচ্ছে। সন্ধ্যার এই সময়টুকু অনন্যা বাকি সবার চা জল খাবার বানাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেও। আজ তার ধারে কাছেও গেলো না। আনমনে ব্যালকনিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফের নিজের বিছানায় এসে ধপাস করে বসে পড়লো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে চেয়েছিলো ঠিক কত বাজে! কিন্ত চোখটা আবার সেই ছবিতেই দৃষ্টিনিবদ্ধ হয়ে রইলো।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অঙ্কনের নতুন ছবি ভাইরাল হয়েছে। নীল জলে যেন গ্রীক দেবতার দৈবাৎ আবির্ভাব! ব্যাক ব্রাশ করা চুলে দুই হাত নিবদ্ধ করে উদোম গায়ে সুইমিং পুলে দাঁড়িয়ে৷ গলার লম্বা লকেটটা বুক পর্যন্ত নেমে যাওয়ায় রোমশ বুকটা হাইলাইটস হচ্ছে। অ্যাথলেটদের মত পেটা, মেদহীন শরীরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে যায়। মুখে সেই বিশ্বজয়ের হাসি আর চোখে বরাবরের মতোই নীলচে দৃষ্টি চুম্বকের মত টানতে থাকে। সেই ছবিতে হাজার হাজার মেয়ের লাভ রিএক্ট সাথে আনলিমিটেড পুতুপুতু কমেন্ট। অনন্যার ইচ্ছে করছে ফোনটা ছুড়ে মারতে। কিন্তু সে মারবে না। এই ফালতু ক্যারেকটার লেস লোকটাকে নিয়ে সে আর ভাবতে চায়না। কিন্তু সেটাও বোধ হয় খুব একটা সম্ভব হবে না। তার চেনা পরিচিতি জগৎ হঠাৎ একদিনের ব্যাবধানে কেমন নাইন্টি ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গেলো! এতোদিনের শিক্ষা জীবনে টপ স্কোরার হয়ে এত এত গদ বাধা মেডেল, ট্রফি পেয়েও মানুষ তাকে যতোটা না চিনলো তার থেকে বেশী চিনে নিলো অঙ্কনের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে। হাউ রিডিউকিউলাস! আজ ভার্সিটির গুন্ডা পোলাপানগুলোও অটোগ্রাফ ম্যাম! অটোগ্রাফ! করে টিজ করতেও ছাড়লোনা। এদের জ্বালায়
শেষ পর্যন্ত ভো দৌড় লাগিয়েছিলো। তাতেও শান্তি পায়নি জুনিয়র একগাদা ছেলেমেয়ে আমতা আমত করে ওর সামনে পড়ে জিজ্ঞাস করেছিলো,
" আপনি অনন্যা না! অঙ্কনের গার্লফ্রেন্ড।"
ইনিয়েবিনিয়ে এটা সেটা জিজ্ঞেস করাতে একরকম বিরক্ত হয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসে। বন্ধুদের পাশে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও আচমকা সেটাও জুটলো না। এদের অধিকাংশই অঙ্কনের সাথে দেখা করিয়ে দেয়ার জন্য মাথা খেয়ে ফেললো। তার উপর ন্যাকা ন্যাকা টাইপের কোয়েশ্চেনতো ম্যান্ডেটরি! যতবার বুঝাতে চাইলো এই গোটা ব্যাপারটাই নাটকীয়! আদতে অঙ্কন তার বয়ফ্রেন্ড নয়। তত যেন বন্ধুরা তার দাম্ভিকতা, লুকিয়ে-চুরিয়ে বেড়ানো মনোভাবের দিকেই আঙ্গুল তুলে অভিমানে মুখ সরিয়ে নিলো। তাতে যেন স্যাররাও আরো গরম ঘি ঢেলে দিলো। এই এক প্রসঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ করে অনন্যাকে বারবার ব্যাথিত করে তুললো। নিহার স্যার শত হাসিতেও যার মুখ বাংলার পাচেঁর মত সে ও আজকে আগ বাড়িয়ে অনন্যার সাথে কথা বললো। কংগ্রাচুলেশনস জানালো। সেই সাথে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে অপ্রস্তুত করে তোললো। লজ্জায়, অপমানে আজকের দিনের গোটা ব্যাপারটাই তার মাথার উপর দিয়ে গেলো। তাই বিষন্ন মনে আজঁ আর ঘর থেকেই বের হয়নি।
" মা আমার। কই আমার মা। তাকে আজঁ দেখছিনা কেন? মা জননী। " আহনাফ সাহেব সোজাসাপ্টা মানুষ তোষামোদের ধারও ধারেন না। তবে ক্ষেত্র বিশেষ মেয়ের বেলায় কদাচিৎ করে থাকেন।
অনন্যা ধাতস্ত হয়ে বাবার দিকে ঘুরে তাকায়। তারপর পূর্বাপেক্ষা শান্ত গলায় বললো," বাবা, এই ন্যাকা ন্যাকা তোষামোদ গুলো আর করবে না। এগুলো তোমাকে মানায় না। প্লিজ জোর করে মায়ের ক্যারেক্টার প্লে করবে না।"
" কি সাংঘাতিক! আমি তোর মায়ের ক্যারেক্টর প্লে করছিলাম নাকি?" আহনাফ এক গাল হেসে মেয়ের পাশে বসলেন।
" হ্যাঁ, তাই করছিলে এবং করে চলেছো।"
আহনাফ মেয়ের টলমল চোখের দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজার চেষ্টা করলো। তারপর আবার চুপসে গেলো। কিছু বললো না।
" বাবা, তুমি কি এখন আমাকে জিজ্ঞেস করবে আমার কি হয়েছে? আগেই বলে দিচ্ছি আমি কিন্তু উত্তর দিতে পারবো না।"
" আমিতো উত্তর টা জানি। একদমই জিজ্ঞেস করবো না।"
অনন্যা এইবার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো ক্রুব্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
" বাবা, সবটা জেনেও তুমি মায়ের কথার তাল দিচ্ছো।"
আহনাফ মেয়েকে থামিয়ে দেয়। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
" লাকী চার্ম ইউ আর এবসিলিউটলি রং! অঙ্কনকে আমার নিজেরো পছন্দ। শুধু শুধু তোমার মায়ের বোকা বোকা কথায় আমি কোনকালেই ভিজিনি। এখনো যে ভিজতে পারি না এটা অন্তত তোমার বোঝা উচিৎ ছিলো।"
অনন্যা দাঁত কিড়মিড় করে আবার বসে পড়লো। তাতে আহনাফ মৃদু হেসে আবার বলতে লাগলেন, " তোমার মায়ের ছেলেবেলার খুব ভালো বান্ধবী ছিলেন অঙ্কনের মা। রিসেন্ট একটা পোগ্রামে তোমার মায়ের সাথে আবার দেখা হয়। পুরোনো বন্ধুকে কাছে পেয়ে গদগদ হয়ে তোমার মা নতুন করে একটা সম্পর্ক পাতাতে চাইতেই পারেন। এটা দোষের কিছু না। তাছাড়া অঙ্কন খুব ভালো ছেলে। লন্ডন থেকে গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করে এসে বাবার এতবড় বিজনেস ফেলে মিডিয়ার দিকে ঝুঁকেছে। এটা দোষের কিছু না। এ বয়সের ছেলেদের ঝোঁকটা একটু অন্যদিকে থাকেই। এরা এডভেঞ্চার প্রিয়। কিন্তু আমার মা জননীর এত অপছন্দের কারণটাই আমি জানতে পারলাম না।"
" বাবা, তুমি এসব বলছো?" অনন্য বিস্মিত হয়ে বাবার দিকে তাকায়। এতোদিনের চেনা পরিচিত স্বভাবের সাথে বাবার আজকের সিদ্ধান্তের কোন মিল না পাওয়ায় মনে মনে ভয়াবহ রকমের চটে গেলো সে।
" হ্যাঁ, আমি তোমার ভালো চাই। এবং বেস্টটাই দিতে চাই। "
" বেস্ট তাই না বাবা! এরা প্রায়শই ক্যারেক্টর লেস হয়। ভয়াবহ রকমের চরিত্রের দোষ থাকে। অসম্ভব আমি কোন হিরো টিরোকে বিয়ে করতে পারবো না।
আহনাফ এইপর্যায়ে মুচকি হেসে মেয়ের দিকে তাকান। তার মানে এখানেই মেয়ের আসল সমস্যা! উনি আবার দ্বিগুন উৎসাহে মুখ টিপে হাসতে লাগলেন। আর বললেন,
" এই হিরোকে একবার বিয়ে করে নাও মা। দ্বিতীয়বার কোন হিরো বা টিরোর নাম ও আমি নেবোনা। এই যে পাক্কা প্রমিস করলাম!"
অতিমাত্রায় হাসির বেদনায় অনন্যা ভ্রু কুচঁকিয়ে মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। কারণ এই মুহুর্তে আহনাফ সাহেব প্রমিজ করেই নিয়েছেন উনি যেকোন উপায়ে মেয়েকে হাসাবেন। অনন্যার নিজের উপর কোন কন্ট্রোল নেয় যেকোন মুহুর্তে বাবার কথার জালে ফেসেঁ হি হি করে হাসতে বাধ্য। তাই মায়ের ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনতেই সে আগ্রহী তাতে রাগ একবার দপ করে উঠবে আবার পড়বে। কারণ হিসেব মতে আজ গোটা দিনটাই তার রাগ দিবস। সেটা যে করেই হোক পালন করতেই হবে।
*************
ইমতিয়াজ সাহেব নিত্যকার অভ্যাসবশত আজকেও ঠান্ডা মেজাজে বসে বসে টিভি দেখছিলেন। একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টাচ্ছিলেন বিরক্তিহীনভাবে।
পাশের উল্টোদিকের সোফায় অনীলা ন্যকা কান্না জুড়ে ফুঁপিয়ে কাদঁছেন। তাতে যেন ইমতিয়াজের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
অনীলা ভয়ানক রাগে দুঃখে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে বলললেন,
" মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছে আর উনি ধৈ ধৈ করে টিভি দেখছেন।"
" বেশ করেছে, আমার কষ্ট করে আর পাত্র খুঁজতে হলো না। সেই সুখেতো আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। নাচবো! নাচি।" ইমতিয়াজ বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে স্ত্রীর দিকে তাকান।
আয়েশা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন।
" তার মানে মেয়ে তোমাকে বলেই গেছে! তুমি সবটা জানতে?"
" না না না। গাধীটা তো তোমার ধাঁচে আমাকে বলতে যাবে কেন? বললেতো আমি নিজেই নিঃসন্দেহে বিয়ে দিয়ে দিতাম। তোমাকে জিজ্ঞেসও করতাম না। বোকা হলে যা হয় আর কি?"
" কার কাছে বিয়ে দিতে শুনি। তোমার অকাল কুষ্মান্ড ভাগ্নের কাছে! লজ্জা করলোনা তোমার এই কথা বলতে।"
" অবশ্যই লজ্জা করছে। কাল থেকে বোরকা পড়ে বের হব কেমন!
আর একটা কথা আসলেই আমার ভাগ্নে অকাল কুষ্মাণ্ড নইলে তোমার গাধী মেয়ের প্রেমে পড়ে। রুচি জ্ঞান যথেষ্ট খারাপ! হায়রে মামা ভাগ্নের কি ভাঙ্গা কপাল!"
আয়েশা লাফিয়ে উঠলো। রাগে দুঃখে নিজের চুল নিজেরি ছিড়তে ইচ্ছে করছে।
পাশের রুমে অঙ্কন আর অন্বেষা একে একে বোনের বন্ধু আর পরিচিত আত্নীয়দের ক্রমাগত ফোন করেই যাচ্ছে। কোথাও খুঁজ পাচ্ছে না। দুই ভাইবোন দুশ্চিন্তায় ছটফট করছে সেই আগুনে বাবা মায়ের কথা কাটাকাটি যেন আরো ঘি ঢেলে দিচ্ছে। অঙ্কন উঠে দাঁড়ায় এক্ষুনি এদের ছেলেমানুষী বন্ধ করা দরকার। ইশ্ এরা যে কবে ম্যাচিউরিটি শিখবে স্বয়ং আল্লাহ জানে!

No comments

Powered by Blogger.